বাংলাদেশে বসবাসরত আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীদের জন্য লিখতে চাচ্ছি। আমাদের বেশিরভাগের জন্যই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আসার ব্যাপারটা আন্ডারগ্র্যাডে থাকতে পরিষ্কার না। এটা ক্যারিয়ার হিসেবে কতটা উপযোগী, আমার পারসোনালিটির সাথে গবেষণাভিত্তিক ক্যারিয়ার কতটা যায়, এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট তথ্য এবং মেন্টরিং এর সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আমি চেষ্টা করবো আমার সাধ্যমত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্য তুলে ধরতে, এবং এই পার্থক্যের ভিত্তিতে কিভাবে নিজেকে দেশে থাকতে তৈরি করা দরকার, সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে। আমার নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড অর্থনীতি, কাজের ক্ষেত্র এনভায়রনমেন্ট এবং এগ্রিকালচার মূলত, অনেকটাই অর্থনৈতিক ইতিহাস ভিত্তিও। আমার ফান্ডিং এর কাজগুলো ইন্টারডিসিপ্লিনারি ছিলো। এইসবের ভিত্তিতে আমার এক্সপেরিয়েন্সে নর্থ আমেরিকার সিস্টেম তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত বিশ্বের উচ্চশিক্ষার সিস্টেমের মূল পার্থক্য কি? এই পার্থক্য আসলে উচ্চশিক্ষার আগেই ফান্ডামেন্টাল কিছু জায়গায় তৈরি হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, স্কুলে আমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রস্তুতি নিতে হোতো, রেজাল্ট ভালো করতে। কিন্তু পুরো প্রস্তুতিটাই প্রায় শতভাগ মুখস্থভিত্তিক। এই প্রস্তুতির মধ্যে থেকে যাওয়ার পরে কি কারো পক্ষে সৃজনশীল হয়ে গড়ে ওঠা সম্ভব? দেশের বাইরে বিশেষত উন্নত বিশ্বের সাথে এটাই পার্থক্য। এখানে "গিলিয়ে" দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা না। সুতরাং হয়তো দেশে থেকে যারা বাইরে পড়ার প্রস্তুতি নিতে চাইছে, তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে "মুখস্থ"বিদ্যার কাছে সপে না দেওয়া। খুঁজে খুঁজে বের করা কোথায় কি করলে নিজের প্রশ্ন করার ক্ষমতা নষ্ট হবে না। গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাইলে এটাই হয়তো প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব।
আন্ডারগ্র্যাডে আরও কিছু সিস্টেমের পার্থক্যের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি হোলো - মেজর। আমাদের সাবজেক্ট কি হবে এটা ভর্তির সময় ভাইভা বোর্ডে ঠিক হয়ে যায় যখন আমাদের বয়স ১৮ বা ১৯, এবং সেই সাবজেক্টে আমাদের পড়াশোনার কোনো ইচ্ছা আছে কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। এমনকি অন্য বিভাগে ক্লাস করাও যায় না। যেকারণে, আমার মত অর্থনীতির ছাত্রদের ম্যাথ বা সট্যাট ক্লাস নিজের বিভাগে যা সম্ভব, সেটুকুই করতে হয়। এইসব কারণে রিয়েল এনালাইসিস বা প্রোবাবিলিটির বেসিক অনেক গোলমাল থাকে। বাইরের ছেলেমেয়ে যারা পাঁচটা ম্যাথ ক্লাস বা পাঁচটা স্ট্যাট ক্লাস করে এসেছে, তাদের সাথে এরপর প্রতিযোগিতা করতে হয় গ্র্যাজুয়েট সকুলে। এরপরের বিশাল সমস্যাটা হচ্ছে আবারো মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক পরীক্ষা সিস্টেম থেকে। আমাদের মোটামুটি সিলেবাসে যা পড়ানো হয় তার বাইরে এনালিটিক্যাল প্রশ্ন আসে না। প্রশ্নপদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের "সলভিং" জাতীয় প্রশ্নে হোঁচট খেতে হয়। ক্লাসভিত্তিক পড়াশোনায় বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হোলো প্রশ্ন করাকে এনকারেজ না করা। বাংলাদেশে শিশু থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ক্লাসে প্রশ্ন করাকে এমনকি অনেক শিক্ষক "বেয়াদবি" হিসেবেও দেখেন। মেন্টর-এডভাইজার বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আমলে অন্তত কিছু ছিলো না তেমন।
আরেকটি বড় ঘাটতির জায়গা হোলো রিসার্চ। ইদানীং বাংলাদেশে বেশ কিছু রিসার্চ অর্গানাইজেশনের জব এডভার্টাইজিং দেখি অনলাইনে, হয়তো অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে। রিসার্চের সাথে এক্সপোজারের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নামকরা জার্নাল, পেপার এসবের সাথে পরিচিত হতে শুরু করা। আমাদের জার্নাল এক্সেসও থাকে না অনেক সময়ই। এরপর ফিল্ড অনুযায়ী যেসব মেথড শেখা দরকার তা শুরু করা - যেমন অর্থনীতিতে স্ট্যাটা, আর, পাইথন, রিমোট সেন্সিং এর চল বেশি। আবার অন্য জায়গায় এসপিএসএস চলে। এই সফটওয়্যার সম্বন্ধে জানা, এবং কিছুটা প্রোগ্রামিং শেখা। একটা পেপার কিভাবে লিখতে হবে, রেফারেন্সগুলো কেমন হবে। টেবিল, গ্রাফ কিভাবে তৈরি করতে হবে, এই ধারণাগুলো থাকলে অনেক সময় বাঁচানো সম্ভব। এসব স্কিলের বাইরে আরেকটি বড় স্কিল হোলো - পিওপল ম্যানেজমেন্ট স্কিল। কোলাবরেশনের যুগে বড় গ্রুপে নেইভ মানুষ হয়ে ঢুকলে উন্নতির অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশাসনিক জায়গায় শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির কারণে অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের হলের রুম, থাকাখাওয়ার মান উন্নত বিশ্ব তো দূরের কথা, অনেক অনুন্নত বিশ্বেরও ধারেকাছে নেই। এই কথাগুলো নিয়ে আসলে আমার লেখার কিছু নেই, আমি কেবলমাত্র ইন্ডিভিজুয়াল জায়গা থেকে একজন ছাত্র এই সিস্টেমের মধ্যেও কিছুটা নিজেকে তৈরি করতে পারে কিনা - সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
মূলত এটা আমার এক্সপেরিয়েন্সে “I wish I had known when I was in my undergrad” পোস্ট। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের সাধ্য এবং সামর্থ্যের মধ্যেই কথা বলার চেষ্টা করবো। আগের পর্ব থেকে তো বুঝতে পারছি আমাদের ঘাটতির কেন্দ্রগুলো কি কিঃ কোর্স, মেথড/স্কিল, রিসার্চ, নেটওয়ার্কিং। আর এর উপর বাড়তি বাংলার নারীসুলভ ভীতির কারণে উদ্যোগী না হওয়া তো আছেই। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ক্যাটাগরিতে যাওয়ার আগে বলে নেই, আমার মতে, আমাদের সবার নিজের বাস্তবতায় নিজের জীবনকে/ক্যারিয়ারকে গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে। আর কেউ কাজ করে দেবে না, নিজে উদ্যোগী না হলে আমরা যেখান থেকেই শুরু করি না কেন, সেখানেই আটকে থাকবো।
কোর্সঃ এই ব্যাপারটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আমি ঢাবিতে থাকতে কঠিন যত কোর্স নেওয়া সম্ভব ছিলো ডিপার্টমেন্টে, তার সবই নিয়েছিলাম। এবং, বাইরে এসে আবিষ্কার করি, অন্য সবার থেকে কত পিছিয়ে আছি। সব কাভার দিতে না পারলেও, কিছু জিনিস দেশে বসে কাভার দিতে পারা উচিত। এর জন্য জানা প্রয়োজন স্ট্যান্ডার্ড পড়াশোনা দেশের বাইরে একই সাবজেক্টে কেমন হচ্ছে। আমাদের শিক্ষকেরা অর্ধেক সিলেবাস ইগনোর করে যান, প্রশ্ন ভ্যারিয়েশন বলতে থাকে না কিছু। কিন্তু টেক্সটবুক হাতের কাছে থাকলে, পুরোটা পড়তে তো সমস্যা নাই কেউ পড়াক বা না পড়াক। এখন ইউটিউবে বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার পাওয়া যায়। এর বাইরে অনেক শিক্ষক নিজের ওয়েবসাইটে বিষয়ভেদে লেকচার, প্রশ্ন তুলে দেন। এখানে লেকচার দেখাটাই শেষ কথা না, কারণ এটা সবাই করতে পারে। কাজ হোলো বের করে দেখা এইসব প্রশ্ন (টেক্সটবুকের স্যামপল অথবা শিক্ষকদের ওয়েবসাইটে পাওয়া ইত্যাদি) সল্ভ করতে পারছি কীনা। টিউটরদের কাছে পড়ে পড়ে, আমাদের ব্রেইনের অনেক অংশ জং ধরে যায়। এখান থেকে বের হতে প্রশ্ন সলভের বিকল্প নেই। ধরুন আপনি, ইন্টারমিডিয়েট মাইক্রোইকনমিক্সের ক্লাস নিচ্ছেন। তাহলে, মূল বই যতদূর সম্ভব ভ্যারিয়েনই পড়ানো হচ্ছে। এই বই এর কিন্তু এক্সারসাইজ বলে আলাদা বইই আছে। অনেক মাইক্রো-ম্যাক্রো বই এরই এমন এক্সারসাইজ বলে আলাদা বই থাকে। নীলক্ষেতেও পুরোনো বই এর দোকান খুঁজলে পাওয়া যায়। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করতে চাইলে এই বাড়তি পরিশ্রমটুকু সিস্টেমের অংশ করে ফেলা উপকারি হবে। এই ব্যাপারে আপনার ডিপার্টমেন্টে সদ্য বাইরে থেকে আসা প্রফেসররা হতে পারেন বিশেষভাবে রিসোর্সফুল। তাদের কাছে যান, কথা বলুন, কি করা প্রয়োজন জিজ্ঞেস করুন।
প্রশ্ন সলভিং এর পরে বিশাল গ্যাপ হচ্ছে প্রোগ্রামিং। আমরা তো অনেকেই স্যোশাল সায়েন্সে গিয়েছিই এইসব এড়িয়ে যেতে, তাই না? আজকের দুনিয়ায় স্যোশাল সায়েন্সের একটা বিশাল অংশ হচ্ছে এমপিরিক্যাল কাজ। এবং, হঠাত করে বাইরে এসে সব একত্রে শেখার চেয়ে একটু একটু আগে শিখে রাখা অনেক কাজের হবে। স্ট্যাটা থেকে কাজ শেখা শুরু করা যায়। এরপর প্রোগ্রামিং ধরে এগোলে কিছু আর, পাইথন শুরু করা যায়। এসবের অনেক টিউটোরিয়াল আজকাল অনলাইনে ফ্রি পাওয়া যায়। আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে, আপনার লাইনে কি ধরণের মেথড/স্কিল প্রয়োজন, এবং সেটা খুঁজে বের করে শেখা শুরু করা। ফিল্ডভেদে এই স্কিল লেভেলও ভিন্ন হয়। যেমন, স্যোশাল সায়েন্সের অনেক ফিল্ডে এথনোগ্রাফিক কাজ শিখতে হয়। সার্ভে করা শিখতে হয়। আপনার ফিল্ডে কি জরুরি, সেটা জেনে বের করে সেই অনুযায়ী প্ল্যান করতে হবে। অনেক জার্নাল এখন ডাটা এবং কোড ফ্রি দিয়ে দেয়, এখান থেকে রিসোর্স নিতে পারেন। আপনার বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রোগ্রামিং এর লাইনে আছে, তাদের কাছে জানতে চান কি করতে হবে, কিভাবে শুরু করা যায়। গ্রুপ করে নিজেরা মিলে শেখা শুরু করুন।
রিসার্চঃ রিসার্চের কাজের সাথে যতটা সম্ভব পরিচিত হওয়া। তারচেয়েও বড় কথা বোঝার চেষ্টা করা রিসার্চ আমার ভালো লাগছে কীনা। রিসার্চকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে হলে প্রচণ্ড প্যাশেন্ট মানুষ হতে হয়। পাঁচ/দশ বছর লাগিয়ে কিছু করার ধৈর্য সবার থাকে না, থাকতে হবে এমন কথাও নেই। কিন্তু যদি না থাকে, তাহলে এই লাইনে কাজ শুরু করলে ফ্রাসট্রেটেড হয়ে পড়তে হতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন ভালো লাগে কীনা? একটা বড় জিনিস হচ্ছে, “জানতে” ভালো লাগে কীনা। ধরুন, আমরা যেহেতু স্যোশাল সায়েন্সের কথা বলছি - দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে, বিভিন্ন মত - থিওরি জানতে কি আগ্রহ বোধ করছেন। তর্ক করতে এইসব বিষয়ে আগ্রহ বোধ করছেন? নীলক্ষেতে হাঁটার পথে হঠাত ইতিহাসের একটা বই দেখে কি আটকে যাচ্ছেন? বের করুন আপনার ক্যাম্পাসে অন্য কারা প্রবন্ধ/সাহিত্য চর্চা করে, এদের অনেকেই পত্রিকা, লিটল ম্যাগ বের করে। এইসব পত্রিকার সাথে কাজ করলে গবেষণার প্রতি আগ্রহ আসলেই পাচ্ছেন কীনা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ঢাকায় “হালখাতা” নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক আমাকে প্রতি তিন মাসে একটা এমন লিখতে দিতেন। আমি ঐ পত্রিকার প্রথম কয়েক সংখ্যায় সবচেয়ে জুনিয়র লেখক ছিলাম অনার্স পড়াকালীন সময়ে। লেখার বিষয়গুলো সব সামাজিক-রাজনৈতিক ছিলো। এই কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ তৈরি করে নিলে লং-টার্মে অনেক কাজে লাগতে পারে।
আপনার ফিল্ডে বড় কাজ কারা করছেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চার কারা? তাদের কাজ, পেপার-বই এসব যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করুন। আপনার ফিল্ডের বাইরে যারা একই বিষয়ে কাজ করেন, তাদেরটাও জানার চেষ্টা করুন। যেমন, আপনি অর্থনীতিতে পড়লে স্যোশিওলজি, পলিটিক্যাল সায়েন্স এগুলো নিয়ে জানার চেষ্টা করুন। ইতিহাস বলতে কিছু আমাদের অর্থনীতি বিভাগে শেখানো হয় না, অথচ ইতিহাসকে বাদ দিলে অর্থনীতি চর্চাই করা সম্ভব না (well, I work on economic history, might be biased!)। আপনার ফিল্ডের লেটেস্ট ডেভেলপমেন্ট গুলো নিয়ে জানার চেষ্টা করুন, সেমিনার - ওয়ার্কশপ আশেপাশে কিছু হলে এটেন্ড করুন। কারো কাজ ভালো লাগলে বোঝার চেষ্টা করুন, কেন ভালো লাগছে। এই কাজের এক্সটেনশন কি হতে পারে?
আপনি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে কাজ শুরু করলে প্রথম এক বছর শুধু সিলেবাস থাকবে। তার পর জ্ঞানের মহাসমুদ্রে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে বলা হবে, নিজের রিসার্চ প্রশ্ন খুঁজে বের করে আনতে। আপনি আজকে যত বেশি পড়বেন, জানবেন, ওপেন চিন্তা করতে - নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে তৈরি থাকবেন, ততই ভালো রিসার্চের বিষয় খুঁজে বের করতে পারবেন। এটা একটা প্র্যাকটিস, নিজেকে সিস্টেমে রেখে চিন্তা করতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞানে কাজ করার সুবিধা হোলো, অনেক প্রশ্ন আমাদের আশেপাশেই পড়ে আছে - শুধু দৃষ্টিশক্তি তৈরি হলেই দেখা সম্ভব। আর এইজন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া। আপনি যখন একটা থিওরি পড়ছেন, ভাবার চেষ্টা করুন আশেপাশের কোন এক্সামপলগুলো দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন ধরুন, আপনি থিওরি পড়লেন মার্কেট রিলেটেড - যা পড়ছেন, তা দিয়ে বাংলাদেশের কাঁচাবাজারকে কি ব্যাখ্যা করতে পারবেন? এটাই চ্যালেঞ্জ। চোখকান খোলা রাখুন, এলার্ট থাকুন। একটা নোটবুক রাখুন প্রথম থেকেই যেখানে আইডিয়া লিখে রাখা যাবে।
রিসার্চ নিয়ে পরবর্তী কাজ হোলো, সেকেন্ড ইয়ার/থার্ড ইয়ার থেকে আশেপাশে দেখা কোথাও এসিস্টেন্ট হিসেবে বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করা যায় কিনা। বাংলাদেশ থেকে কানাডা আসার আগে আমি দুই জায়গায় কয়েক মাস করে কাজ করেছিলাম, এই কাজের মাধ্যমে আপনার কিছু এক্সপেরিয়েন্স হবে, যেটা প্রথমত সিভিতেও জরুরি। আবার, পরে নিজের রিসার্চ শুরু করার সময়ও জরুরি। চেষ্টা করুন, এমন কারো সাথে কাজ করতে যে আসলেই স্ক্লার। আপনাকে গাইড করতে সমর্থ।
নেটওয়ার্কিংঃ নেটওয়ার্কিংকে বাংলাদেশে খুব বাজে ভাষায় ডাকা হয়। যেমন, শেয়ারমার্কেটের ব্রোকারকে বাংলাদেশে অনেকে বলে “দালাল” তেমনি। এটা আমাদের সমাজের হীনমন্যতা, নলেজ-বিমুখীতা। একজন ছাত্র হিসেবে আপনার অধিকার এবং দায়িত্ব আপনার জন্য সঠিক মেন্টর খুঁজে বের করা। কার সাথে কথা বললে সে আপনাকে গাইড করতে পারবে? দেশের ভেতরে বা বাইরে কার কার এচিভমেন্ট আপনাকে প্রেরণা দেয়? এদের কাছে কোল্ড ইমেইল করুন, প্রফেশনাল - টু দি পয়েন্ট। আপনি কে, কি করছেন, কেন ইমেইল করছেন। আমি ফেসবুকে নক দেওয়াকে আনপ্রফেশনাল মনে করি পারসোনালি, কারণ আপনার চেয়ে এরা বেশ সিনিয়র, এবং এদের সাথে আপনার পারসোনাল সম্পর্ক না। দরকার হলে নক করে ইমেইল আইডি নিয়ে তারপর ইমেইল করুন। আপনি যা ভাবছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ আপনাকে সাহায্য করবে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কারা সিরিয়াসলি কাজ করছেন, কাদের কাছে শিখতে পারছেন - তাদের সাথে কথা বলুন। অফিস আওয়ারে যান, দেখা করুন, আপনি কি করতে চান - এদের জানান। সাজেশন চান। অনেকে নেগেটিভ কথা বলতেও পারে, কিন্তু এই ব্লগের শুরুতেই যেমন বলেছি, আমাদের দায়িত্ব নিতে জানতে হবে। আর তার মানে হচ্ছে অন্যের কথায় নিরুৎসাহিত না হওয়া।
সিনিয়রদের সাথে নেটওয়ার্কিং এর সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হোলো সমবয়সীদের সাথে নেটওয়ার্কিং। অনেকসময় মনে হতে পারে যে আশেপাশের সবাই সারাদিন স্থূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, আমি কিছু শিখছি না। এখানেও আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। খুঁজে বের করুন, আপনার ক্যাম্পাসে অন্য কারা আছে পড়াশোনা করতে আগ্রহী, জানতে আগ্রহী। পত্রিকা বের করছে যারা, ডিবেটিং ক্লাবের সদস্য যারা, এরা সাধারণত এলার্ট থাকে। আপনার নিজের মত করে এম্বিশাস বন্ধু খুঁজে বের করুন, যারা নিজেরা গণ্ডীর বাইরে চিন্তা করতে চায়। এমন মানুষ অনেক আছে আশেপাশে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে কিছু এরকম বন্ধু পেয়েছিলাম (আমি ভাগ্যবান ছিলাম), যাদের মাধ্যমে বিশ্বের বড় বড় কিছু লেখক - গবেষক সম্বন্ধে জেনেছিলাম।
বাইরে আসার জন্য অনার্স বা মাস্টার্সের পর কি কি কাগুজে প্রস্তুতি নিতে হয়, কিভাবে নিতে হয় - তার উপর অনেকগুলো হায়ার স্টাডিজ রিলেটেড ফেসবুক গ্রুপ আছে। বাইরে এসে পড়াশোনার প্রস্তুতি নিতে চাইলে এইসব গ্রুপে আন্ডারগ্র্যাড থার্ড ইয়ার/ফোর্থ ইয়ার থেকে জয়েন করে থাকা ভালো। দেশভেদে পরীক্ষা জিআরই, টোফেল, আইএলটিএস এর কোনো একটি বা দুইটি হতে হয়। এইসব পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে আমার হিসেবে ৪/৫ মাস সময় লাগে। প্রিপারেশন কিভাবে নিতে হবে, তা এইসব গ্রুপ থেকে ডিটেইলস জানা যাবে। বাংলাদেশের অনেক অধ্যাপক রেফারেন্স লেটার দিতে খুব ঝামেলা করেন, সুতরাং রেফারেন্স লেটারের জন্য আগে থেকে প্ল্যান করে রাখা ভালো। অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট স্কুলগুলো ফল সেমিস্টারে শুরু হয়, এর জন্য এপ্লিকেশন ডেডলাইন থাকে অক্টোবর-জানুয়ারি এর মধ্যে কোনো সময়। ক্রেডিট কার্ড এর এক্সেস লাগবে এপ্লাই করতে। প্রতিটি স্কুলে সব মিলিয়ে আপনার ১০,০০০ এর মত খরচ হতে পারে, আর জিআরই টোফেল সব মিলিয়ে ৪০,০০০ এর দিকে খরচ হতে পারে। সুতরাং, পুরো প্রসেসটা বেশ এক্সপেন্সিভ। কত লাগবে, কখন লাগবে এই হিসেবগুলো মাথায় রাখা জরুরি। আগে থেকে নিজেই কিছু সেইভ শুরু করে রাখাও ভালো। আমি প্রিপারেশন নিয়ে তেমন কিছু বলছি না। কারণ, এর উপর অনেক কথা ফেসবুকে, ইউটিউবে আছে।
আমি বরং দেশ ছাড়ার আগে পারসোনাল কিছু প্রিপারেশনের কথা বলতে চাই, কারণ সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে সব কিছুর চাপ সামলাতে না পেরে অনেক গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টই ডিপ্রেশনে চলে যায়।
প্রথমত, দেশের স্কুল-কলেজে অনেক প্রেশারের মধ্যে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনার সারাবছর চাপ খুব কমই থাকে। সেখানে থেকে বাইরে এসে হঠাত দিবারাত্র কাজের চাপ সহ্য করা কঠিন। এর জন্য কিছু মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে আসা ভালো। সামারে দেশে থাকা অবস্থাতেই ইমেইল করুন আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন, সেখানকার সিনিয়র স্টুডেন্টদের। জানতে চান, কোন কোন টেক্সটবই লাগতে পারে। সিলেবাস পাওয়া সম্ভব কিনা। আপনি যদি এভাবে কিছুটা আগে থেকে গুছিয়ে রাখেন, তাহলে গিয়ে অথৈ সাগরে পড়বেন না। অন্তত আপনার প্ল্যান থাকবে কি কি করা লাগবে।
দ্বিতীয়ত, দেশে আমরা যারা বাবা-মা এর সাথে থেকে হঠাত বাইরে চলে আসি, অনেকেই নিজের ফাইন্যান্স, নিজের খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড় ইত্যাদির হিসেব জানি না। এগুলো অভ্যাসের ব্যাপার, কঠিনও না; কিন্তু একেবারেই অভ্যাসে না থাকলে পড়াশোনার চাপের পাশে এত মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যায়। আপনি কিছু প্ল্যান করে আসুন, যেমন ব্রেকফাস্ট - লাঞ্চ - ডিনারে আপনার নিজের শরীর অনুযায়ী কি কি দরকার হয়। আপনি ১০ টা আপনার চলে এমন রেসিপি শিখে আসুন। প্রয়োজনে বাজারে গিয়ে অভ্যাস করুন, যাতে এসে একবার গ্রোসারিতে অনেক সময় না চলে যায়। আমার নিজের ক্ষেত্রে লিস্ট ধরে গ্রোসারি করা, প্ল্যান করে রান্না করা, আগে থেকেই এক সপ্তাহে কি কি খাবো ঠিক করে রাখা - এগুলো অনেক সাহায্য করেছে (এগুলো সব ঠেকে ধীরে ধীরে বোঝা কোন সিস্টেম ভালো)। লন্ড্রি মেশিন বাসাতেই থাকার কথা, অনেকের পাবলিক লন্ড্রিতে যেতে হতে পারে। সেটা উইকএন্ডে ব্যবস্থা করে রাখা ভালো।
মোটকথা, পড়াশোনার বাইরের অন্যান্য রেগুলার কাজগুলোকে সিস্টেমে এনে ফেললে আপনার সময় কম নষ্ট হবে। এইসব দেশে বাইরের খাবার অনেক দামি, আপনি যদি বাইরে খেতে চান প্রথম দিকে - সেটা খারাপ মানের খাবার হয়ে যেতে পারে। তাই, নিজে এই সিস্টেম ঠিক করে রাখা এবং নতুন জিনিসে ওপেন থাকা জরুরি। যেমন, আমি কাজের চাপের মধ্যে বাঙালি রান্না বাদ দিয়ে চাইনিজ স্যুপ, ন্যুডলস এগুলো বেশি করি। এতে আমার ১০/১৫ মিনিটের বেশি লাগে না। প্রথম কয়েক মাস ফাইন্যান্সিয়ালি আপনার খুব “টাইট” লাগতে পারে। ধীরে ধীরে সব সিস্টেমে এসে যাবে। নর্থ আমেরিকায় গ্রোসারিতে ভালো মানের খাবার আপনি বেশ এফোর্ড করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশি অনেকেই দেশের বাইরে এসে কেবল দেশি কমিউনিটি খুঁজে বেড়ায়। আমি তাদের সমালোচনা করছি না, এটা পারসোনাল চয়েস। কিন্তু আপনি যদি গ্রো করতে চান, আমার কাছে অন্য দেশের মানুষ দেখা, তাদের কালচার সম্বন্ধে জানা, শেখা এগুলো খুব জরুরি মনে হয়। হঠাত কোনো মানুষের সাথে কি কথা বলবেন, এই নিয়ে বই আছে অনেক। তবে একাডেমিয়াতে একটা সাধারণ কথা হচ্ছে, মানুষ সবসময় তার রিসার্চ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, সে এখন কি নিয়ে কাজ করছে, মানুষ নিজেই অনেক ডিটেইলস শুরু করে দেবে। আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়া, ঢাবিতে পড়া; দেশের বাইরে এসে অনেক আনকমফোর্টেবল লাগতো, এক্সেন্ট ভাষা এইসব নিয়ে। কিন্তু আপনি যত বেশি কথা বলবেন, তত শিখবেন কিভাবে কমিউনিকেট করতে হয়। দেশী পার্টিগুলোতে যে স্কিল আপনার তৈরি হবে না। আপনি আপনার সহনক্ষমতা অনুযায়ী নিজের কমিউনিটি তৈরি করুন।
ফোর্থ, একাডেমিয়ার সাথে আপনার প্রথম সংযোগ তৈরি হয় আপনার ক্লাসমেট আর কোর্স টিচার, টিএ এদের মাধ্যমে। যত বেশি পারুন, নিজেকে এস্টাবলিশ করার চেষ্টা করুন। আপনি এম্প্যাথেটিক, সেনসিটিভ, হেল্পফুল হলে মানুষ আপনাকে এমনিতেই গ্রহণ করবে। কমিউনিটির কাজ - যেমন, সেমিনার এটেন্ড করা, ফ্রাইডে গ্যাদারিং এ যাওয়া, ক্লাসমেটদের সাথে আউটিং এ যাওয়া - এগুলো এটেন্ড করুন। হোমওয়ার্ক গ্রুপ বেঁধে সবার সাথে করার চেষ্টা করুন। ক্লাসে অন্য অনেকে আপনার চেয়ে অনেক স্কিল্ড থাকতেই পারে, এদের সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে আমাদের তো আর দিন যাবে না। বরং, দেশে থাকতে আপনি কি জানতেন এবং বাইরে আসার পর প্রতিদিন কতটা শিখছেন, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। ডিপ্রেসনের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, নিজেকে আলাদা করে নেওয়া। এটা করা থেকে বিরত রাখুন নিজেকে। মানুষের সাহায্য চান, দরকার হলে ক্যাম্পাস থেরাপিস্টের কাছে যান। নিজেকে আইসোলেটেড করে ফেললে অনেক অসুবিধা হবে।
বাংলাদেশের মানুষের একটা কমন সমস্যা হচ্ছে নিজের কথা বলতেই থাকা (নিজের জীবন নিয়ে নালিশ করতেই থাকা-বাংলায় ঘ্যানরঘ্যানর বলা যেতে পারে)। এইসব পারসোনালিটি সমস্যা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত আমাদের। আপনার শেখার আগ্রহ আছে - এই কথা প্রফেসরদের দৃষ্টিতেও আসা প্রয়োজন। অফিস আওয়ারে যাওয়া, ক্লাসে ডিসকাশনে অংশ নেওয়া ইত্যাদি অনেক হেল্পফুল। বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলো অনেক রিসোর্সফুল। আপনি সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কিংবা সন্ধ্যায় অফিসে থেকে অন্য গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের সাথে আড্ডাতেই অনেক কিছু শিখবেন। মাস্টার্স করতে আসলে গিয়ে পিএইচডি স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলুন। তাদের এক্সপেরিয়েন্স জানতে চান। দেখুন, মানুষ কিভাবে কাজ করছে - কি নিয়ে কাজ করছে। মানুষের একটা কমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে যা নিয়ে এক্সাইটেড, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে খুশি হয়। এই হিউম্যান ন্যাচারকে বুঝে একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলে অনেক কিছু শেখা সম্ভব।
ফিফথ, রাইটিং এর জন্য গ্র্যাজুয়েট কলেজ অনেক ওয়ার্কশপ করায়। আপনি বাংলা মিডিয়াম হলে বা জেনারেলি লেখা নিয়ে অস্বস্তি থাকলে, এইসব ওয়ার্কশপ অনেক সাহায্য করে। এগুলো ছাত্রদের জন্য ফ্রি থাকে। কলেজে অনেক সফটওয়্যার ওয়ার্কশপও থাকে - আপনি প্রোগ্রামিং বা কিছু শিখতে চাইলে, এসব কাজে লাগাতে পারেন। আপনার যদি টিচিং করতে হয়, ফান্ডিং এর জন্য - সেক্ষেত্রে টিচিং রিলেটেড ওয়ার্কশপগুলোও আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে।
রাইটিং এর ক্ষেত্রে আমার নিজের কিছু এক্সপেরিয়েন্স নিচে পয়েন্ট আকারে শেয়ার করলাম।
প্রথমত, রিসার্চ পেপার লেখার একটা ফরম্যাট থাকে। বিষয়ভেদে এটা আলাদা, কিন্তু মোটামুটি একটা ধাঁচ ফলো করা হয়। এই ফরম্যাটটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নেওয়া উচিত। বড় জার্নালের কয়েকটা ভালো পেপার নিয়ে পড়ে ফরম্যাট বোঝাটা সবচেয়ে সহজতর উপায়। যেমন, ইকনমিক্সের ক্ষেত্রে আমেরিকান ইকনমিক রিভিউ এর কয়েকটা পেপার নিয়ে বসলে অবশ্যই বেসিক আইডিয়া পাওয়ার কথা।
দ্বিতীয়ত, রেফারেন্স লিস্ট/ বিবলিওগ্রাফি কিভাবে তৈরি করে শিখে ফেলা। জার্নাল ফলো করে, গুগল স্কলার দেখে শেখা সম্ভব।
তৃতীয়ত, টেকনিক্যালি নিজেকে বিল্ড আপ করা। রেফারেন্স ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের সাথে পরিচিত হওয়াটা জরুরি। লেখার জন্য ওয়ার্ড এর পাশাপাশি ল্যাটেক্স শিখে ফেলা। ওভারলিফে ফ্রি একাউন্ট খুলেই ফরম্যাট ইউজ করা যায়। আপনি যে সফটওয়্যার ইউজ করেন, স্ট্যাটা - আর - ম্যাটল্যাব - তা থেকে কিভাবে টেবিল, গ্রাফ আপনার রাইটিং সফটওয়্যারে নেবেন, এটা শেখা।
এগুলো সহজ কাজ, কিন্তু আগে থেকে জানতাম না বলে, পিএইচডিতে ঢুকে সব একত্রে শেখা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিলো।
ফোর্থ, এবার আসা যাক, আসল রাইটিং এ। আমার ধারণা বাংলা মিডিয়ামে আমাদের যেভাবে ইংরেজি শেখানো হোতো, তার প্রথম কয়েকটা ঝামেলা হচ্ছে, ১) সেন্টেন্স যত কমপ্লিকেটেড, যত লম্বা, এবং/যদি/কিন্তু ভরা, তত ভালো, this is our perception। এটা ভুল। আমি আসলে লিখছি একটা অডিয়েন্সের জন্য যারা আমার মতই গবেষণা করে, তারা আমার একটা পেপারে হাজার ঘণ্টা সময় দেবে না। লেখা ডাইরেক্ট হওয়া, সিম্পল হওয়া জরুরি। আমি আগে ছয়/সাত লাইন ধরে একটা বাক্য লিখতাম, নিজেই পড়ে পরে বুঝতে পারতাম না! আরেকটা ঝামেলা হোলো, প্যাসিভ ভয়েস ব্যবহার করা। লেখা যত পারা যায়, একটিভ ভয়েসে হওয়া উচিত। আমার রিসার্চ পেপারের প্রতিটা লাইনের দায় আমার, যদি প্যাসিভ ভয়েসে লিখি - অনেকটা মনে হয়, আর কেউ করে দিয়েছে, আমি ঠিক এইসব ভুল হলে দায়িত্ব নিচ্ছি না। এইদুটো জিনিস আমি এখন কেয়ারফুল থাকার চেষ্টা করি।
ফিফথ, আর্টিকেলের ব্যবহার। এটা আমি এখনো খুব কনফিউজ থাকি, কিন্তু খুব জরুরি একটা ব্যাপার। ইকনমিক্সে অন্তত লেখা প্রেজেন্ট টেন্সে রাখা প্রেফার করা হয়। প্রতিটা প্যারাগ্রাফের শেষের সাথে তার পরের প্যারাগ্রাফের শুরুটা যেন কানেক্টেড থাকে, খেয়াল রাখা। নাহলে মনে হবে জাম্পিং করে করে যাচ্ছে লেখা।
ষষ্ঠ, গ্রামার এর জন্য ভালো কিছু বই সংগ্রহে রাখা জরুরি। রাইটিং এর জন্য আলাদাভাবে The Craft of Research এবং Economical Writing পড়ানো হয় এইখানে গ্র্যাজুয়েট সকুলে। এই বইগুলো খুব ভালো।
সপ্তম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেখা শুরু করা। নিজের ভেতরে ভয়ের জন্য দেখা যায় লেখা নিয়ে আমরা প্রোক্রাস্টিনেট করি। লেখাকে ভালো করার প্রথম উপায় হচ্ছে সময় দেওয়া। আমার নিজের লেখাই পড়লে বুঝি যেটা সময় দিয়ে লেখা সেটা অনেক বেশি পঠনযোগ্য। রেজাল্ট হাতে না থাকলে কেবল ডাটা সেকশন, কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড কিছু কিছু সেকশন লেখা শুরু করে দেওয়া। প্রয়োজনে অন্যদের সাথে গ্রুপ করে একত্রে লিখলে লেখার প্রতি দায়বদ্ধতা আসে।
অষ্টম, লেখা কিছুটা দাঁড় হওয়ার পর সাহায্য নেওয়া, অন্যদের ফিডব্যাক চাওয়া। লেখার মান নিয়ে লজ্জাবোধ থাকলে এই সাহায্য চাওয়া কঠিন। কিন্তু এটা খুব হেল্পফুল। আমার নিজের পিএইচডি প্রোগ্রামে রাইটিং ক্লাস ছিলো, তাতে অন্যদের ফিডব্যাক অনেক হেল্প করেছে।
নবম, আর কী - প্র্যাকটিস। যত বেশি ঘষামাজা করা যায়, ততই ভালো।
হ্যাপি লার্নিং!
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত বিশ্বের উচ্চশিক্ষার সিস্টেমের মূল পার্থক্য কি? এই পার্থক্য আসলে উচ্চশিক্ষার আগেই ফান্ডামেন্টাল কিছু জায়গায় তৈরি হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, স্কুলে আমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রস্তুতি নিতে হোতো, রেজাল্ট ভালো করতে। কিন্তু পুরো প্রস্তুতিটাই প্রায় শতভাগ মুখস্থভিত্তিক। এই প্রস্তুতির মধ্যে থেকে যাওয়ার পরে কি কারো পক্ষে সৃজনশীল হয়ে গড়ে ওঠা সম্ভব? দেশের বাইরে বিশেষত উন্নত বিশ্বের সাথে এটাই পার্থক্য। এখানে "গিলিয়ে" দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা না। সুতরাং হয়তো দেশে থেকে যারা বাইরে পড়ার প্রস্তুতি নিতে চাইছে, তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে "মুখস্থ"বিদ্যার কাছে সপে না দেওয়া। খুঁজে খুঁজে বের করা কোথায় কি করলে নিজের প্রশ্ন করার ক্ষমতা নষ্ট হবে না। গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাইলে এটাই হয়তো প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব।
আন্ডারগ্র্যাডে আরও কিছু সিস্টেমের পার্থক্যের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি হোলো - মেজর। আমাদের সাবজেক্ট কি হবে এটা ভর্তির সময় ভাইভা বোর্ডে ঠিক হয়ে যায় যখন আমাদের বয়স ১৮ বা ১৯, এবং সেই সাবজেক্টে আমাদের পড়াশোনার কোনো ইচ্ছা আছে কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। এমনকি অন্য বিভাগে ক্লাস করাও যায় না। যেকারণে, আমার মত অর্থনীতির ছাত্রদের ম্যাথ বা সট্যাট ক্লাস নিজের বিভাগে যা সম্ভব, সেটুকুই করতে হয়। এইসব কারণে রিয়েল এনালাইসিস বা প্রোবাবিলিটির বেসিক অনেক গোলমাল থাকে। বাইরের ছেলেমেয়ে যারা পাঁচটা ম্যাথ ক্লাস বা পাঁচটা স্ট্যাট ক্লাস করে এসেছে, তাদের সাথে এরপর প্রতিযোগিতা করতে হয় গ্র্যাজুয়েট সকুলে। এরপরের বিশাল সমস্যাটা হচ্ছে আবারো মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক পরীক্ষা সিস্টেম থেকে। আমাদের মোটামুটি সিলেবাসে যা পড়ানো হয় তার বাইরে এনালিটিক্যাল প্রশ্ন আসে না। প্রশ্নপদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের "সলভিং" জাতীয় প্রশ্নে হোঁচট খেতে হয়। ক্লাসভিত্তিক পড়াশোনায় বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হোলো প্রশ্ন করাকে এনকারেজ না করা। বাংলাদেশে শিশু থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ক্লাসে প্রশ্ন করাকে এমনকি অনেক শিক্ষক "বেয়াদবি" হিসেবেও দেখেন। মেন্টর-এডভাইজার বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আমলে অন্তত কিছু ছিলো না তেমন।
আরেকটি বড় ঘাটতির জায়গা হোলো রিসার্চ। ইদানীং বাংলাদেশে বেশ কিছু রিসার্চ অর্গানাইজেশনের জব এডভার্টাইজিং দেখি অনলাইনে, হয়তো অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে। রিসার্চের সাথে এক্সপোজারের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নামকরা জার্নাল, পেপার এসবের সাথে পরিচিত হতে শুরু করা। আমাদের জার্নাল এক্সেসও থাকে না অনেক সময়ই। এরপর ফিল্ড অনুযায়ী যেসব মেথড শেখা দরকার তা শুরু করা - যেমন অর্থনীতিতে স্ট্যাটা, আর, পাইথন, রিমোট সেন্সিং এর চল বেশি। আবার অন্য জায়গায় এসপিএসএস চলে। এই সফটওয়্যার সম্বন্ধে জানা, এবং কিছুটা প্রোগ্রামিং শেখা। একটা পেপার কিভাবে লিখতে হবে, রেফারেন্সগুলো কেমন হবে। টেবিল, গ্রাফ কিভাবে তৈরি করতে হবে, এই ধারণাগুলো থাকলে অনেক সময় বাঁচানো সম্ভব। এসব স্কিলের বাইরে আরেকটি বড় স্কিল হোলো - পিওপল ম্যানেজমেন্ট স্কিল। কোলাবরেশনের যুগে বড় গ্রুপে নেইভ মানুষ হয়ে ঢুকলে উন্নতির অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশাসনিক জায়গায় শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির কারণে অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের হলের রুম, থাকাখাওয়ার মান উন্নত বিশ্ব তো দূরের কথা, অনেক অনুন্নত বিশ্বেরও ধারেকাছে নেই। এই কথাগুলো নিয়ে আসলে আমার লেখার কিছু নেই, আমি কেবলমাত্র ইন্ডিভিজুয়াল জায়গা থেকে একজন ছাত্র এই সিস্টেমের মধ্যেও কিছুটা নিজেকে তৈরি করতে পারে কিনা - সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
মূলত এটা আমার এক্সপেরিয়েন্সে “I wish I had known when I was in my undergrad” পোস্ট। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের সাধ্য এবং সামর্থ্যের মধ্যেই কথা বলার চেষ্টা করবো। আগের পর্ব থেকে তো বুঝতে পারছি আমাদের ঘাটতির কেন্দ্রগুলো কি কিঃ কোর্স, মেথড/স্কিল, রিসার্চ, নেটওয়ার্কিং। আর এর উপর বাড়তি বাংলার নারীসুলভ ভীতির কারণে উদ্যোগী না হওয়া তো আছেই। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ক্যাটাগরিতে যাওয়ার আগে বলে নেই, আমার মতে, আমাদের সবার নিজের বাস্তবতায় নিজের জীবনকে/ক্যারিয়ারকে গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে। আর কেউ কাজ করে দেবে না, নিজে উদ্যোগী না হলে আমরা যেখান থেকেই শুরু করি না কেন, সেখানেই আটকে থাকবো।
কোর্সঃ এই ব্যাপারটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আমি ঢাবিতে থাকতে কঠিন যত কোর্স নেওয়া সম্ভব ছিলো ডিপার্টমেন্টে, তার সবই নিয়েছিলাম। এবং, বাইরে এসে আবিষ্কার করি, অন্য সবার থেকে কত পিছিয়ে আছি। সব কাভার দিতে না পারলেও, কিছু জিনিস দেশে বসে কাভার দিতে পারা উচিত। এর জন্য জানা প্রয়োজন স্ট্যান্ডার্ড পড়াশোনা দেশের বাইরে একই সাবজেক্টে কেমন হচ্ছে। আমাদের শিক্ষকেরা অর্ধেক সিলেবাস ইগনোর করে যান, প্রশ্ন ভ্যারিয়েশন বলতে থাকে না কিছু। কিন্তু টেক্সটবুক হাতের কাছে থাকলে, পুরোটা পড়তে তো সমস্যা নাই কেউ পড়াক বা না পড়াক। এখন ইউটিউবে বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার পাওয়া যায়। এর বাইরে অনেক শিক্ষক নিজের ওয়েবসাইটে বিষয়ভেদে লেকচার, প্রশ্ন তুলে দেন। এখানে লেকচার দেখাটাই শেষ কথা না, কারণ এটা সবাই করতে পারে। কাজ হোলো বের করে দেখা এইসব প্রশ্ন (টেক্সটবুকের স্যামপল অথবা শিক্ষকদের ওয়েবসাইটে পাওয়া ইত্যাদি) সল্ভ করতে পারছি কীনা। টিউটরদের কাছে পড়ে পড়ে, আমাদের ব্রেইনের অনেক অংশ জং ধরে যায়। এখান থেকে বের হতে প্রশ্ন সলভের বিকল্প নেই। ধরুন আপনি, ইন্টারমিডিয়েট মাইক্রোইকনমিক্সের ক্লাস নিচ্ছেন। তাহলে, মূল বই যতদূর সম্ভব ভ্যারিয়েনই পড়ানো হচ্ছে। এই বই এর কিন্তু এক্সারসাইজ বলে আলাদা বইই আছে। অনেক মাইক্রো-ম্যাক্রো বই এরই এমন এক্সারসাইজ বলে আলাদা বই থাকে। নীলক্ষেতেও পুরোনো বই এর দোকান খুঁজলে পাওয়া যায়। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করতে চাইলে এই বাড়তি পরিশ্রমটুকু সিস্টেমের অংশ করে ফেলা উপকারি হবে। এই ব্যাপারে আপনার ডিপার্টমেন্টে সদ্য বাইরে থেকে আসা প্রফেসররা হতে পারেন বিশেষভাবে রিসোর্সফুল। তাদের কাছে যান, কথা বলুন, কি করা প্রয়োজন জিজ্ঞেস করুন।
প্রশ্ন সলভিং এর পরে বিশাল গ্যাপ হচ্ছে প্রোগ্রামিং। আমরা তো অনেকেই স্যোশাল সায়েন্সে গিয়েছিই এইসব এড়িয়ে যেতে, তাই না? আজকের দুনিয়ায় স্যোশাল সায়েন্সের একটা বিশাল অংশ হচ্ছে এমপিরিক্যাল কাজ। এবং, হঠাত করে বাইরে এসে সব একত্রে শেখার চেয়ে একটু একটু আগে শিখে রাখা অনেক কাজের হবে। স্ট্যাটা থেকে কাজ শেখা শুরু করা যায়। এরপর প্রোগ্রামিং ধরে এগোলে কিছু আর, পাইথন শুরু করা যায়। এসবের অনেক টিউটোরিয়াল আজকাল অনলাইনে ফ্রি পাওয়া যায়। আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে, আপনার লাইনে কি ধরণের মেথড/স্কিল প্রয়োজন, এবং সেটা খুঁজে বের করে শেখা শুরু করা। ফিল্ডভেদে এই স্কিল লেভেলও ভিন্ন হয়। যেমন, স্যোশাল সায়েন্সের অনেক ফিল্ডে এথনোগ্রাফিক কাজ শিখতে হয়। সার্ভে করা শিখতে হয়। আপনার ফিল্ডে কি জরুরি, সেটা জেনে বের করে সেই অনুযায়ী প্ল্যান করতে হবে। অনেক জার্নাল এখন ডাটা এবং কোড ফ্রি দিয়ে দেয়, এখান থেকে রিসোর্স নিতে পারেন। আপনার বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রোগ্রামিং এর লাইনে আছে, তাদের কাছে জানতে চান কি করতে হবে, কিভাবে শুরু করা যায়। গ্রুপ করে নিজেরা মিলে শেখা শুরু করুন।
রিসার্চঃ রিসার্চের কাজের সাথে যতটা সম্ভব পরিচিত হওয়া। তারচেয়েও বড় কথা বোঝার চেষ্টা করা রিসার্চ আমার ভালো লাগছে কীনা। রিসার্চকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে হলে প্রচণ্ড প্যাশেন্ট মানুষ হতে হয়। পাঁচ/দশ বছর লাগিয়ে কিছু করার ধৈর্য সবার থাকে না, থাকতে হবে এমন কথাও নেই। কিন্তু যদি না থাকে, তাহলে এই লাইনে কাজ শুরু করলে ফ্রাসট্রেটেড হয়ে পড়তে হতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন ভালো লাগে কীনা? একটা বড় জিনিস হচ্ছে, “জানতে” ভালো লাগে কীনা। ধরুন, আমরা যেহেতু স্যোশাল সায়েন্সের কথা বলছি - দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে, বিভিন্ন মত - থিওরি জানতে কি আগ্রহ বোধ করছেন। তর্ক করতে এইসব বিষয়ে আগ্রহ বোধ করছেন? নীলক্ষেতে হাঁটার পথে হঠাত ইতিহাসের একটা বই দেখে কি আটকে যাচ্ছেন? বের করুন আপনার ক্যাম্পাসে অন্য কারা প্রবন্ধ/সাহিত্য চর্চা করে, এদের অনেকেই পত্রিকা, লিটল ম্যাগ বের করে। এইসব পত্রিকার সাথে কাজ করলে গবেষণার প্রতি আগ্রহ আসলেই পাচ্ছেন কীনা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ঢাকায় “হালখাতা” নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক আমাকে প্রতি তিন মাসে একটা এমন লিখতে দিতেন। আমি ঐ পত্রিকার প্রথম কয়েক সংখ্যায় সবচেয়ে জুনিয়র লেখক ছিলাম অনার্স পড়াকালীন সময়ে। লেখার বিষয়গুলো সব সামাজিক-রাজনৈতিক ছিলো। এই কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ তৈরি করে নিলে লং-টার্মে অনেক কাজে লাগতে পারে।
আপনার ফিল্ডে বড় কাজ কারা করছেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চার কারা? তাদের কাজ, পেপার-বই এসব যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করুন। আপনার ফিল্ডের বাইরে যারা একই বিষয়ে কাজ করেন, তাদেরটাও জানার চেষ্টা করুন। যেমন, আপনি অর্থনীতিতে পড়লে স্যোশিওলজি, পলিটিক্যাল সায়েন্স এগুলো নিয়ে জানার চেষ্টা করুন। ইতিহাস বলতে কিছু আমাদের অর্থনীতি বিভাগে শেখানো হয় না, অথচ ইতিহাসকে বাদ দিলে অর্থনীতি চর্চাই করা সম্ভব না (well, I work on economic history, might be biased!)। আপনার ফিল্ডের লেটেস্ট ডেভেলপমেন্ট গুলো নিয়ে জানার চেষ্টা করুন, সেমিনার - ওয়ার্কশপ আশেপাশে কিছু হলে এটেন্ড করুন। কারো কাজ ভালো লাগলে বোঝার চেষ্টা করুন, কেন ভালো লাগছে। এই কাজের এক্সটেনশন কি হতে পারে?
আপনি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে কাজ শুরু করলে প্রথম এক বছর শুধু সিলেবাস থাকবে। তার পর জ্ঞানের মহাসমুদ্রে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে বলা হবে, নিজের রিসার্চ প্রশ্ন খুঁজে বের করে আনতে। আপনি আজকে যত বেশি পড়বেন, জানবেন, ওপেন চিন্তা করতে - নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে তৈরি থাকবেন, ততই ভালো রিসার্চের বিষয় খুঁজে বের করতে পারবেন। এটা একটা প্র্যাকটিস, নিজেকে সিস্টেমে রেখে চিন্তা করতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞানে কাজ করার সুবিধা হোলো, অনেক প্রশ্ন আমাদের আশেপাশেই পড়ে আছে - শুধু দৃষ্টিশক্তি তৈরি হলেই দেখা সম্ভব। আর এইজন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া। আপনি যখন একটা থিওরি পড়ছেন, ভাবার চেষ্টা করুন আশেপাশের কোন এক্সামপলগুলো দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন ধরুন, আপনি থিওরি পড়লেন মার্কেট রিলেটেড - যা পড়ছেন, তা দিয়ে বাংলাদেশের কাঁচাবাজারকে কি ব্যাখ্যা করতে পারবেন? এটাই চ্যালেঞ্জ। চোখকান খোলা রাখুন, এলার্ট থাকুন। একটা নোটবুক রাখুন প্রথম থেকেই যেখানে আইডিয়া লিখে রাখা যাবে।
রিসার্চ নিয়ে পরবর্তী কাজ হোলো, সেকেন্ড ইয়ার/থার্ড ইয়ার থেকে আশেপাশে দেখা কোথাও এসিস্টেন্ট হিসেবে বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করা যায় কিনা। বাংলাদেশ থেকে কানাডা আসার আগে আমি দুই জায়গায় কয়েক মাস করে কাজ করেছিলাম, এই কাজের মাধ্যমে আপনার কিছু এক্সপেরিয়েন্স হবে, যেটা প্রথমত সিভিতেও জরুরি। আবার, পরে নিজের রিসার্চ শুরু করার সময়ও জরুরি। চেষ্টা করুন, এমন কারো সাথে কাজ করতে যে আসলেই স্ক্লার। আপনাকে গাইড করতে সমর্থ।
নেটওয়ার্কিংঃ নেটওয়ার্কিংকে বাংলাদেশে খুব বাজে ভাষায় ডাকা হয়। যেমন, শেয়ারমার্কেটের ব্রোকারকে বাংলাদেশে অনেকে বলে “দালাল” তেমনি। এটা আমাদের সমাজের হীনমন্যতা, নলেজ-বিমুখীতা। একজন ছাত্র হিসেবে আপনার অধিকার এবং দায়িত্ব আপনার জন্য সঠিক মেন্টর খুঁজে বের করা। কার সাথে কথা বললে সে আপনাকে গাইড করতে পারবে? দেশের ভেতরে বা বাইরে কার কার এচিভমেন্ট আপনাকে প্রেরণা দেয়? এদের কাছে কোল্ড ইমেইল করুন, প্রফেশনাল - টু দি পয়েন্ট। আপনি কে, কি করছেন, কেন ইমেইল করছেন। আমি ফেসবুকে নক দেওয়াকে আনপ্রফেশনাল মনে করি পারসোনালি, কারণ আপনার চেয়ে এরা বেশ সিনিয়র, এবং এদের সাথে আপনার পারসোনাল সম্পর্ক না। দরকার হলে নক করে ইমেইল আইডি নিয়ে তারপর ইমেইল করুন। আপনি যা ভাবছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ আপনাকে সাহায্য করবে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কারা সিরিয়াসলি কাজ করছেন, কাদের কাছে শিখতে পারছেন - তাদের সাথে কথা বলুন। অফিস আওয়ারে যান, দেখা করুন, আপনি কি করতে চান - এদের জানান। সাজেশন চান। অনেকে নেগেটিভ কথা বলতেও পারে, কিন্তু এই ব্লগের শুরুতেই যেমন বলেছি, আমাদের দায়িত্ব নিতে জানতে হবে। আর তার মানে হচ্ছে অন্যের কথায় নিরুৎসাহিত না হওয়া।
সিনিয়রদের সাথে নেটওয়ার্কিং এর সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হোলো সমবয়সীদের সাথে নেটওয়ার্কিং। অনেকসময় মনে হতে পারে যে আশেপাশের সবাই সারাদিন স্থূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, আমি কিছু শিখছি না। এখানেও আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। খুঁজে বের করুন, আপনার ক্যাম্পাসে অন্য কারা আছে পড়াশোনা করতে আগ্রহী, জানতে আগ্রহী। পত্রিকা বের করছে যারা, ডিবেটিং ক্লাবের সদস্য যারা, এরা সাধারণত এলার্ট থাকে। আপনার নিজের মত করে এম্বিশাস বন্ধু খুঁজে বের করুন, যারা নিজেরা গণ্ডীর বাইরে চিন্তা করতে চায়। এমন মানুষ অনেক আছে আশেপাশে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে কিছু এরকম বন্ধু পেয়েছিলাম (আমি ভাগ্যবান ছিলাম), যাদের মাধ্যমে বিশ্বের বড় বড় কিছু লেখক - গবেষক সম্বন্ধে জেনেছিলাম।
বাইরে আসার জন্য অনার্স বা মাস্টার্সের পর কি কি কাগুজে প্রস্তুতি নিতে হয়, কিভাবে নিতে হয় - তার উপর অনেকগুলো হায়ার স্টাডিজ রিলেটেড ফেসবুক গ্রুপ আছে। বাইরে এসে পড়াশোনার প্রস্তুতি নিতে চাইলে এইসব গ্রুপে আন্ডারগ্র্যাড থার্ড ইয়ার/ফোর্থ ইয়ার থেকে জয়েন করে থাকা ভালো। দেশভেদে পরীক্ষা জিআরই, টোফেল, আইএলটিএস এর কোনো একটি বা দুইটি হতে হয়। এইসব পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে আমার হিসেবে ৪/৫ মাস সময় লাগে। প্রিপারেশন কিভাবে নিতে হবে, তা এইসব গ্রুপ থেকে ডিটেইলস জানা যাবে। বাংলাদেশের অনেক অধ্যাপক রেফারেন্স লেটার দিতে খুব ঝামেলা করেন, সুতরাং রেফারেন্স লেটারের জন্য আগে থেকে প্ল্যান করে রাখা ভালো। অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট স্কুলগুলো ফল সেমিস্টারে শুরু হয়, এর জন্য এপ্লিকেশন ডেডলাইন থাকে অক্টোবর-জানুয়ারি এর মধ্যে কোনো সময়। ক্রেডিট কার্ড এর এক্সেস লাগবে এপ্লাই করতে। প্রতিটি স্কুলে সব মিলিয়ে আপনার ১০,০০০ এর মত খরচ হতে পারে, আর জিআরই টোফেল সব মিলিয়ে ৪০,০০০ এর দিকে খরচ হতে পারে। সুতরাং, পুরো প্রসেসটা বেশ এক্সপেন্সিভ। কত লাগবে, কখন লাগবে এই হিসেবগুলো মাথায় রাখা জরুরি। আগে থেকে নিজেই কিছু সেইভ শুরু করে রাখাও ভালো। আমি প্রিপারেশন নিয়ে তেমন কিছু বলছি না। কারণ, এর উপর অনেক কথা ফেসবুকে, ইউটিউবে আছে।
আমি বরং দেশ ছাড়ার আগে পারসোনাল কিছু প্রিপারেশনের কথা বলতে চাই, কারণ সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে সব কিছুর চাপ সামলাতে না পেরে অনেক গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টই ডিপ্রেশনে চলে যায়।
প্রথমত, দেশের স্কুল-কলেজে অনেক প্রেশারের মধ্যে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনার সারাবছর চাপ খুব কমই থাকে। সেখানে থেকে বাইরে এসে হঠাত দিবারাত্র কাজের চাপ সহ্য করা কঠিন। এর জন্য কিছু মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে আসা ভালো। সামারে দেশে থাকা অবস্থাতেই ইমেইল করুন আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন, সেখানকার সিনিয়র স্টুডেন্টদের। জানতে চান, কোন কোন টেক্সটবই লাগতে পারে। সিলেবাস পাওয়া সম্ভব কিনা। আপনি যদি এভাবে কিছুটা আগে থেকে গুছিয়ে রাখেন, তাহলে গিয়ে অথৈ সাগরে পড়বেন না। অন্তত আপনার প্ল্যান থাকবে কি কি করা লাগবে।
দ্বিতীয়ত, দেশে আমরা যারা বাবা-মা এর সাথে থেকে হঠাত বাইরে চলে আসি, অনেকেই নিজের ফাইন্যান্স, নিজের খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড় ইত্যাদির হিসেব জানি না। এগুলো অভ্যাসের ব্যাপার, কঠিনও না; কিন্তু একেবারেই অভ্যাসে না থাকলে পড়াশোনার চাপের পাশে এত মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যায়। আপনি কিছু প্ল্যান করে আসুন, যেমন ব্রেকফাস্ট - লাঞ্চ - ডিনারে আপনার নিজের শরীর অনুযায়ী কি কি দরকার হয়। আপনি ১০ টা আপনার চলে এমন রেসিপি শিখে আসুন। প্রয়োজনে বাজারে গিয়ে অভ্যাস করুন, যাতে এসে একবার গ্রোসারিতে অনেক সময় না চলে যায়। আমার নিজের ক্ষেত্রে লিস্ট ধরে গ্রোসারি করা, প্ল্যান করে রান্না করা, আগে থেকেই এক সপ্তাহে কি কি খাবো ঠিক করে রাখা - এগুলো অনেক সাহায্য করেছে (এগুলো সব ঠেকে ধীরে ধীরে বোঝা কোন সিস্টেম ভালো)। লন্ড্রি মেশিন বাসাতেই থাকার কথা, অনেকের পাবলিক লন্ড্রিতে যেতে হতে পারে। সেটা উইকএন্ডে ব্যবস্থা করে রাখা ভালো।
মোটকথা, পড়াশোনার বাইরের অন্যান্য রেগুলার কাজগুলোকে সিস্টেমে এনে ফেললে আপনার সময় কম নষ্ট হবে। এইসব দেশে বাইরের খাবার অনেক দামি, আপনি যদি বাইরে খেতে চান প্রথম দিকে - সেটা খারাপ মানের খাবার হয়ে যেতে পারে। তাই, নিজে এই সিস্টেম ঠিক করে রাখা এবং নতুন জিনিসে ওপেন থাকা জরুরি। যেমন, আমি কাজের চাপের মধ্যে বাঙালি রান্না বাদ দিয়ে চাইনিজ স্যুপ, ন্যুডলস এগুলো বেশি করি। এতে আমার ১০/১৫ মিনিটের বেশি লাগে না। প্রথম কয়েক মাস ফাইন্যান্সিয়ালি আপনার খুব “টাইট” লাগতে পারে। ধীরে ধীরে সব সিস্টেমে এসে যাবে। নর্থ আমেরিকায় গ্রোসারিতে ভালো মানের খাবার আপনি বেশ এফোর্ড করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশি অনেকেই দেশের বাইরে এসে কেবল দেশি কমিউনিটি খুঁজে বেড়ায়। আমি তাদের সমালোচনা করছি না, এটা পারসোনাল চয়েস। কিন্তু আপনি যদি গ্রো করতে চান, আমার কাছে অন্য দেশের মানুষ দেখা, তাদের কালচার সম্বন্ধে জানা, শেখা এগুলো খুব জরুরি মনে হয়। হঠাত কোনো মানুষের সাথে কি কথা বলবেন, এই নিয়ে বই আছে অনেক। তবে একাডেমিয়াতে একটা সাধারণ কথা হচ্ছে, মানুষ সবসময় তার রিসার্চ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, সে এখন কি নিয়ে কাজ করছে, মানুষ নিজেই অনেক ডিটেইলস শুরু করে দেবে। আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়া, ঢাবিতে পড়া; দেশের বাইরে এসে অনেক আনকমফোর্টেবল লাগতো, এক্সেন্ট ভাষা এইসব নিয়ে। কিন্তু আপনি যত বেশি কথা বলবেন, তত শিখবেন কিভাবে কমিউনিকেট করতে হয়। দেশী পার্টিগুলোতে যে স্কিল আপনার তৈরি হবে না। আপনি আপনার সহনক্ষমতা অনুযায়ী নিজের কমিউনিটি তৈরি করুন।
ফোর্থ, একাডেমিয়ার সাথে আপনার প্রথম সংযোগ তৈরি হয় আপনার ক্লাসমেট আর কোর্স টিচার, টিএ এদের মাধ্যমে। যত বেশি পারুন, নিজেকে এস্টাবলিশ করার চেষ্টা করুন। আপনি এম্প্যাথেটিক, সেনসিটিভ, হেল্পফুল হলে মানুষ আপনাকে এমনিতেই গ্রহণ করবে। কমিউনিটির কাজ - যেমন, সেমিনার এটেন্ড করা, ফ্রাইডে গ্যাদারিং এ যাওয়া, ক্লাসমেটদের সাথে আউটিং এ যাওয়া - এগুলো এটেন্ড করুন। হোমওয়ার্ক গ্রুপ বেঁধে সবার সাথে করার চেষ্টা করুন। ক্লাসে অন্য অনেকে আপনার চেয়ে অনেক স্কিল্ড থাকতেই পারে, এদের সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে আমাদের তো আর দিন যাবে না। বরং, দেশে থাকতে আপনি কি জানতেন এবং বাইরে আসার পর প্রতিদিন কতটা শিখছেন, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। ডিপ্রেসনের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, নিজেকে আলাদা করে নেওয়া। এটা করা থেকে বিরত রাখুন নিজেকে। মানুষের সাহায্য চান, দরকার হলে ক্যাম্পাস থেরাপিস্টের কাছে যান। নিজেকে আইসোলেটেড করে ফেললে অনেক অসুবিধা হবে।
বাংলাদেশের মানুষের একটা কমন সমস্যা হচ্ছে নিজের কথা বলতেই থাকা (নিজের জীবন নিয়ে নালিশ করতেই থাকা-বাংলায় ঘ্যানরঘ্যানর বলা যেতে পারে)। এইসব পারসোনালিটি সমস্যা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত আমাদের। আপনার শেখার আগ্রহ আছে - এই কথা প্রফেসরদের দৃষ্টিতেও আসা প্রয়োজন। অফিস আওয়ারে যাওয়া, ক্লাসে ডিসকাশনে অংশ নেওয়া ইত্যাদি অনেক হেল্পফুল। বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলো অনেক রিসোর্সফুল। আপনি সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কিংবা সন্ধ্যায় অফিসে থেকে অন্য গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের সাথে আড্ডাতেই অনেক কিছু শিখবেন। মাস্টার্স করতে আসলে গিয়ে পিএইচডি স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলুন। তাদের এক্সপেরিয়েন্স জানতে চান। দেখুন, মানুষ কিভাবে কাজ করছে - কি নিয়ে কাজ করছে। মানুষের একটা কমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে যা নিয়ে এক্সাইটেড, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে খুশি হয়। এই হিউম্যান ন্যাচারকে বুঝে একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলে অনেক কিছু শেখা সম্ভব।
ফিফথ, রাইটিং এর জন্য গ্র্যাজুয়েট কলেজ অনেক ওয়ার্কশপ করায়। আপনি বাংলা মিডিয়াম হলে বা জেনারেলি লেখা নিয়ে অস্বস্তি থাকলে, এইসব ওয়ার্কশপ অনেক সাহায্য করে। এগুলো ছাত্রদের জন্য ফ্রি থাকে। কলেজে অনেক সফটওয়্যার ওয়ার্কশপও থাকে - আপনি প্রোগ্রামিং বা কিছু শিখতে চাইলে, এসব কাজে লাগাতে পারেন। আপনার যদি টিচিং করতে হয়, ফান্ডিং এর জন্য - সেক্ষেত্রে টিচিং রিলেটেড ওয়ার্কশপগুলোও আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে।
রাইটিং এর ক্ষেত্রে আমার নিজের কিছু এক্সপেরিয়েন্স নিচে পয়েন্ট আকারে শেয়ার করলাম।
প্রথমত, রিসার্চ পেপার লেখার একটা ফরম্যাট থাকে। বিষয়ভেদে এটা আলাদা, কিন্তু মোটামুটি একটা ধাঁচ ফলো করা হয়। এই ফরম্যাটটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নেওয়া উচিত। বড় জার্নালের কয়েকটা ভালো পেপার নিয়ে পড়ে ফরম্যাট বোঝাটা সবচেয়ে সহজতর উপায়। যেমন, ইকনমিক্সের ক্ষেত্রে আমেরিকান ইকনমিক রিভিউ এর কয়েকটা পেপার নিয়ে বসলে অবশ্যই বেসিক আইডিয়া পাওয়ার কথা।
দ্বিতীয়ত, রেফারেন্স লিস্ট/ বিবলিওগ্রাফি কিভাবে তৈরি করে শিখে ফেলা। জার্নাল ফলো করে, গুগল স্কলার দেখে শেখা সম্ভব।
তৃতীয়ত, টেকনিক্যালি নিজেকে বিল্ড আপ করা। রেফারেন্স ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের সাথে পরিচিত হওয়াটা জরুরি। লেখার জন্য ওয়ার্ড এর পাশাপাশি ল্যাটেক্স শিখে ফেলা। ওভারলিফে ফ্রি একাউন্ট খুলেই ফরম্যাট ইউজ করা যায়। আপনি যে সফটওয়্যার ইউজ করেন, স্ট্যাটা - আর - ম্যাটল্যাব - তা থেকে কিভাবে টেবিল, গ্রাফ আপনার রাইটিং সফটওয়্যারে নেবেন, এটা শেখা।
এগুলো সহজ কাজ, কিন্তু আগে থেকে জানতাম না বলে, পিএইচডিতে ঢুকে সব একত্রে শেখা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিলো।
ফোর্থ, এবার আসা যাক, আসল রাইটিং এ। আমার ধারণা বাংলা মিডিয়ামে আমাদের যেভাবে ইংরেজি শেখানো হোতো, তার প্রথম কয়েকটা ঝামেলা হচ্ছে, ১) সেন্টেন্স যত কমপ্লিকেটেড, যত লম্বা, এবং/যদি/কিন্তু ভরা, তত ভালো, this is our perception। এটা ভুল। আমি আসলে লিখছি একটা অডিয়েন্সের জন্য যারা আমার মতই গবেষণা করে, তারা আমার একটা পেপারে হাজার ঘণ্টা সময় দেবে না। লেখা ডাইরেক্ট হওয়া, সিম্পল হওয়া জরুরি। আমি আগে ছয়/সাত লাইন ধরে একটা বাক্য লিখতাম, নিজেই পড়ে পরে বুঝতে পারতাম না! আরেকটা ঝামেলা হোলো, প্যাসিভ ভয়েস ব্যবহার করা। লেখা যত পারা যায়, একটিভ ভয়েসে হওয়া উচিত। আমার রিসার্চ পেপারের প্রতিটা লাইনের দায় আমার, যদি প্যাসিভ ভয়েসে লিখি - অনেকটা মনে হয়, আর কেউ করে দিয়েছে, আমি ঠিক এইসব ভুল হলে দায়িত্ব নিচ্ছি না। এইদুটো জিনিস আমি এখন কেয়ারফুল থাকার চেষ্টা করি।
ফিফথ, আর্টিকেলের ব্যবহার। এটা আমি এখনো খুব কনফিউজ থাকি, কিন্তু খুব জরুরি একটা ব্যাপার। ইকনমিক্সে অন্তত লেখা প্রেজেন্ট টেন্সে রাখা প্রেফার করা হয়। প্রতিটা প্যারাগ্রাফের শেষের সাথে তার পরের প্যারাগ্রাফের শুরুটা যেন কানেক্টেড থাকে, খেয়াল রাখা। নাহলে মনে হবে জাম্পিং করে করে যাচ্ছে লেখা।
ষষ্ঠ, গ্রামার এর জন্য ভালো কিছু বই সংগ্রহে রাখা জরুরি। রাইটিং এর জন্য আলাদাভাবে The Craft of Research এবং Economical Writing পড়ানো হয় এইখানে গ্র্যাজুয়েট সকুলে। এই বইগুলো খুব ভালো।
সপ্তম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেখা শুরু করা। নিজের ভেতরে ভয়ের জন্য দেখা যায় লেখা নিয়ে আমরা প্রোক্রাস্টিনেট করি। লেখাকে ভালো করার প্রথম উপায় হচ্ছে সময় দেওয়া। আমার নিজের লেখাই পড়লে বুঝি যেটা সময় দিয়ে লেখা সেটা অনেক বেশি পঠনযোগ্য। রেজাল্ট হাতে না থাকলে কেবল ডাটা সেকশন, কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড কিছু কিছু সেকশন লেখা শুরু করে দেওয়া। প্রয়োজনে অন্যদের সাথে গ্রুপ করে একত্রে লিখলে লেখার প্রতি দায়বদ্ধতা আসে।
অষ্টম, লেখা কিছুটা দাঁড় হওয়ার পর সাহায্য নেওয়া, অন্যদের ফিডব্যাক চাওয়া। লেখার মান নিয়ে লজ্জাবোধ থাকলে এই সাহায্য চাওয়া কঠিন। কিন্তু এটা খুব হেল্পফুল। আমার নিজের পিএইচডি প্রোগ্রামে রাইটিং ক্লাস ছিলো, তাতে অন্যদের ফিডব্যাক অনেক হেল্প করেছে।
নবম, আর কী - প্র্যাকটিস। যত বেশি ঘষামাজা করা যায়, ততই ভালো।
হ্যাপি লার্নিং!